আম্মার বাড়ি আম্মার মন -শরিফ মুহাম্মাদ

BDBoiGhor.com
আম্মার বাড়ি আম্মার মন -শরিফ মুহাম্মাদ
বোধ হওয়ার বয়স শুরু হলো। সাত, আট, নয়। তখন থেকেই দেখতাম। আম্মার তখন মন খারাপ। আম্মার তখন মন ভালো। কথা কম বলতেন। চুপচাপ থাকতেন। কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন। আর হঠাৎ হঠাৎ শুনতাম দুটি গজলের গুনগুন। এত চাপা, এত মিষ্টি! আর এত সুখী! কোনো গজলের এমন সুর আমি আর শুনিনি। দুটি গজলই বিখ্যাত। হয়তো কিশোরী বয়সেই ঠোঁটে তুলে নিয়েছিলেন। হয়তো শুনতে শুনতে শিখে ফেলেছিলেন। একটি ছিল: হাসবি রাব্বি জাল্লাল্লাহ। মা-ফি ক্বালবি গাইরুল্লাহ। নূর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ।আরেকটি ছিল: ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়/ আয় রে সাগর আকাশ-বাতাস দেখবি যদি আয়...
কাজ বন্ধ করে গাইতেন কি? মনে হয় না। প্রস্তুতি নিয়ে গাইতেন না। গাইছেন বলে মনে হতো না, কিন্তু গাইতেন। কাজ করতে থাকতেন। চলতো ঘরদোর গোছগাছ। চলতো রান্নাবান্না। মুখের ভেতর থেকে শুধু সুর ভেসে আসতো। মনের ভেতর থেকে গুনগুন নেমে আসতো। শোনার মতো করে শুনতাম না। যেন শুনছি না। এভাবেই শুনতাম। মন মেলে দিয়ে, কান খাড়া করে শুনতে থাকতাম।ভালোলাগা বোধ তৈরি হতো। বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তো। আনমনা হয়ে বসে থাকতাম।
আম্মার ভালো লাগা, আম্মার খারাপ লাগা। আমার মধ্যে তৈরি করত উচ্ছ্বাস ও উদ্বেগ। ছোটকাল থেকেই। শিশুবয়স থেকেই। হয়তো সব শিশুর ক্ষেত্রেই এমন করে, এমন হয়। আমার বেলায়ও হতো। আম্মা ছিলেন নিচুকণ্ঠ। বড় নিঃশব্দ তাঁর অভিব্যক্তি। অনেক ভাবলেশহীন এক মানবী, নিজস্ব বিষয়ে। দেখে কিছুই বোঝা যেত না। বুঝতে পারলে অস্থির লাগতো। হঠাৎ কোনোদিন আম্মার চোখে পানি দেখেছি। আমার চোখে সেদিন পানি আসেনি-এমন হয়নি। আম্মার চোখে খুশির ঝিলিক দেখেছি। আমার বুকে হাসির ফোয়ারা ছোটেনি-এমন হয়নি।
এক রাতের কথা। গভীর রাত। বাসায় আব্বা আসেননি তখনো। তীব্র ঝড় শুরু হলো। সব লন্ডভন্ড করে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আধাপাকা বাসা। টিনের চালে বিকট শব্দ। আছড়ে আছড়ে পড়ছে। এর মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে গেল হঠাৎ। আম্মা ব্যস্ত হয়ে হারিকেন খুঁজতে লাগলেন। হারিকেনে কেরোসিন নেই। ঘরে কোনো মোমবাতি নেই। আলো জ্বালানোর কোনো ব্যবস্থাই নেই। অন্ধকার ঘুটঘুটে বাসা। আর ঝড়ের বিকট শব্দ। বড় ঘরে আম্মা আমাদের ভাইবোনদের একসঙ্গে কাছে নিয়ে বসলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, 'আমার ভয় লাগছে। ঝড় হচ্ছে। এই রাতে অন্ধকার ভালো লাগছে না।'
গলার স্বরটা তার ভারী আর অচেনা। 'আলো জ্বালানোর মতো কিছু লাগবে।' ঝড় একটু থামছে। একটু বাড়ছে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। 'আম্মা! কোন বাসায় যাব।' তিনি বড় একটি চাদর গায়ে দিলেন। একটি ছাতা হাতে নিলেন। আমি আম্মার সঙ্গে। আলোহীন একটি হারিকেন আমার হাতে। কিছুদূর পর এক নানার বাসায়। আমি দরজায় ধাক্কা দিলাম। আমি সশব্দে কেঁদে উঠলাম। তারা দরজা খুললেন। অবাক হলেন আমাকে দেখে। আম্মা দূরে দাঁড়িয়ে গাছের নিচে, অন্ধকারে। কেরোসিন ভরা হারিকেন, মোম, আলো এই জ্বলে এই নেভে। এভাবেই বাসায় ফিরে এলাম। থেমে থেমে ঝড় চলছে তখনো।
হারিকেনের আলো জ্বলে উঠলো বাসায়। একটু আগে এত অসহায় লাগছিল আমার! এত অসহায় লাগছিল! এবার আম্মা শান্ত হয়ে বসলেন। হারিকেনের আলোয় আমাদের মুখের দিকে তাকালেন। ঝোড়ো বাতাস বইছে বাইরে। তাঁর মুখের দিকে আমার চোখ। আমার ভেতরের ঝড় তখন পুরোপুরি থেমে গেল।
[রঙিন মখমল দিন || আম্মার বাড়ি আম্মার মন]
পোস্ট লিংকঃ