লালবাগ কেল্লায় একদিন

BDBoiGhor.com
লালবাগ কেল্লায় একদিন
ঢাকার পথে পথে অনেক দিন ধরেই লালবাগ কেল্লায় যাবো যাবো করছিলাম।কিন্তু যাওয়া হয়ে উঠছিলো না। আজকে হঠাৎ করেই Tawhid Hridoy ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললো লালবাগ কেল্লায় যাবে। হুটহাট রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম। জানিনা কিভাবে যায়!কোন দিক দিয়ে যায়। Najir Muhammad কে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করে কিছু টা দিকনির্দেশনা পেলাম।তারপরের বাকিটা পথে সঙ্গি ছিলো গুগল ম্যাপ। যাত্রাবাড়ি থেকে সদরঘাট, বাবুবাজার,চকবাজার, বাংলাবাজার চলাচলের একমাত্র গণপরিবহন বাহাদুর শাহ।নামের সাথে অবশ্য বাসের কোন মিল নেই।মুড়ির টিনের মতো লক্কর ঝক্কর। ঠিকমত দাঁড়ানো যায় না ভেতরে।উপরের ছাদে মাথা আটকে যায়। ১৫ টাকা ভাড়া দিয়ে আসলাম সদরঘাট।অবশ্য আমরা জানতাম না এটা সদরঘাট। বড় বড় ব্যানারে সদরঘাট লেখা দেখে পরে বুঝতে পারলাম।মনে মনে কিছু টা খুশিই হলাম।সদরঘাটও দেখা হয়ে যাবে তাহলে।এতো দিন ঢাকা থেকেও এগুলো তে আসা হয় নি।ভেতরে প্রবেশ করার জন্য দশ টাকা দিয়ে টিকেট কাটতে হয়।কিন্তু টিকেট কাউন্টারে কাউকে দেখতে পেলাম না।বন্ধ। কি আর করা টিকেক না নিয়েই ভেতরে ডুকলাম।বুড়িগঙ্গার পঁচা পানির বিশ্রি গন্ধ ছিলো।জাহাজ গুলো কতো বিশাল বিশাল। কত্তো ওজন। বিশাল দেহি জাহাজ গুলো হাসের মতো সাতার কাটে নদী সাগরে।আমাদের ভ্রমণ তালিকায় সদরঘাট ছিলো না।তাই খুব বেশি সময় সেখানে থাকি নি।পরবর্তী গন্তব্য আহসান মঞ্জিল।গুগল ম্যাপ বলছে খুব কাছেই।যেতে মাত্র চার মিনিট লাগবে।কিন্তু না চিনলে যা হয় আর কি। দশ মিনিট পর খোঁজে পেলাম আহসান মঞ্জিল। অবশ্য এখানে গুগলের কোন দোষ ছিলো না।হঠাৎ করেই নেট চলে গিয়েছিলো।ফলে গুগলও ডিরেকশন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো।হাতের কাছে রেখেই পাই নি এতোক্ষণ। কিন্তু দুঃখের কথা হলো আজ আহসান মঞ্জিলের সাপ্তাহিক বন্ধ। ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। কি আর করা গেইট থেকে দেখেই ফিরে আসতে হলো। তারপরে গন্তব্য তাঁরা মসজিদ। মসজিদ টা কে নিয়ে অনেক আগে বিটিভিতে প্রতিবেদন দেখেছিলাম।আমাদের আগেকার পঞ্চাশ টাকার নোটেও তাঁরা মসজিদের ছবি ছিলো।গুগল বলছে আহসান মঞ্জিল থেকে ১৪ মিনিট লাগবে তাঁরা মসজিদে যেতে।লাগলো বিশ মিনিটেরো বেশি।বেশ জ্যাম ছিলো।ছোট্ট রাস্তা,সে তুলনায় গাড়ি অনেক।সবই সদরঘাট থেকে আসছে অথবা যাচ্ছে। সদরঘাটে বৈচিত্র্যরকমের মানুষদের মিলনমেলা।সবাই কর্মব্যস্ত।অবশেষে তাঁরা মসজিদে আসলাম।জৌলুশ পূর্ণ মসজিদের যে ছবি টা দেখেছি বাস্তবতার সাথে তার বিস্তর ফারাক।সামনের অস্থায়ী চালা বারান্দা টা মসজিদের সৌন্দর্য নষ্ট করেছে।ভেতরে কিছুক্ষণ বসলাম।একটা প্রশান্তি অনুভব করলাম। ততক্ষণে ১২ টা বেজে গেছে। কিছু খেতে হবে। হাজী বিরিয়ানি হাউজ নামের একটি দোকানে খাওয়া হলো।এবার গন্তব্য লালবাগ কেল্লায়।গুগল বলছে ১৭ মিনিট লাগবে। হাটতে লাগলাম।কিন্তু এইবার গুগল মামা বড় ধোঁকা দিলো। ১৫ মিনিট হাটর পর এখনো ১৭ মিনিট দেখাচ্ছে। ব্যাপার টা কেমন কটকা লাগলো।ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম নেট নেই। ইমারজেন্সি দেখাচ্ছে। আমাদের দেশের ফোর জি? পথে কেন্দ্রীয় কারাগারের দেখাও পেলাম কিছুক্ষণ পর নেট আসলে বুঝতে পারলাম গুগলের ডিরেকশনকৃত রাস্তা নয় এটা। চকবাজার পার হয়ে অন্য এক রাস্তায় চলে এসেছে।অবশ্য গুগলের সাজেস্ট করা রাস্তার চে এদিক দিয়ে কেল্লা আরো কাছে।কেল্লার সামনে লম্বা লাইন। অনেক দর্শনার্থী।বিশ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম।এতোদিন বইয়ের পাতায় পড়া আস্ত ইতিহাসে পা রাখলাম। লালবাগ কেল্লার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস :- এটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন যাতে একই সাথে ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টি পাথর, মার্বেল পাথর আর নানান রঙবেরঙের টালি। লালবাগ কেল্লা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোন ঐতিহাসিক নিদর্শনে এমন কিছুর সংমিশ্রণ পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত। প্রায় প্রতিদিন হাজারো দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীর পদচারণয় মুখরিত হয় ঢাকার লালবাগ এলাকার এই দুর্গটি। বর্তমানে সুবেদার শায়েস্তা খাঁনের বাসভবন ও দরবার হল ‘লালবাগ কেল্লা জাদুঘর’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নামকরণ প্রথমে আওরঙ্গবাদ এলাকার নামের সাথে মিল রেখে কেল্লার নাম দেয়া হয়েছিল আওরঙ্গবাদ দূর্গ বা আওরঙ্গবাদ কেল্লা। ১৮৪৪ সালে আওরঙ্গবাদ এলাকাটির নাম পরিবর্তন করে লালবাগ রাখা হয়। এলাকার নামের সাথে সাথে কেল্লাটির নামও পরিবর্তিত হয়ে লালবাগ কেল্লা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। লালবাগ কেল্লার অবস্থান ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায় অবস্থিত। ইতিহাসের পাতায় লালবাগ কেল্লা লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৭৮ সালে। তৎকালীন মুঘল সম্রাট আজম শাহ এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। যদিও আজম শাহ খুব কম সময়ের জন্যেই মুঘল সম্রাট হিসেবে ছিলেন। তবুও তার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তার এই অসাধারণ কাজটি শুরু করেন। উল্লেখ্য আজম শাহ ছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর পুত্র আর সম্রাট শাহ জাহানের নাতি, যিনি তাজমহল তৈরির জন্যে বিশ্ব মহলে ব্যাপক সমাদৃত। এই দুর্গ নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার প্রায় এক বছরের মাথায় তার বাবার ডাকে তাকে দিল্লিতে চলে যেতে হয় সেখানকার মারাঠা বিদ্রোহ দমন করবার জন্যে। সম্রাট আজম শাহ চলে যাওয়ার পর দুর্গ নির্মাণের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখন এই দুর্গ নির্মাণের কাজ আদৌ সম্পূর্ণ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। কিন্তু সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তৎকালীন নবাব শায়েস্তা খাঁ পুনরায় লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করে দেন কাজ থেমে যাওয়ার প্রায় এক বছর পরে। পুরো উদ্যমে আবার কাজ চলতে থাকে দুর্গ নির্মাণের। তবে শায়েস্তা খাঁ পুনরায় কাজ শুরু করার প্রায় চার বছরের মাথায় দুর্গের নির্মাণ কাজ আবার বন্ধ হয়ে যায়, এরপর দুর্গটি নির্মাণের কাজ আর শুরু করা হয়নি। নবাব শায়েস্তা খাঁ এর মেয়ে পরী বিবি মারা যাওয়ার কারণেই মূলত শায়েস্তা খাঁ লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। পরী বিবির মৃত্যুর পরে সবার মধ্যে দুর্গটি সম্পর্কে বিরুপ ধারণা জন্ম নেয়, সবাই দুর্গটিকে অপয়া ভাবতে শুরু করে দেয়। পরী বিবির মৃত্যুর পর তাকে লালবাগ দুর্গের মাঝেই সমাহিত করা হয়, আর এরপর থেকে একে পরী বিবির সমাধি নামে আখ্যায়িত করা হয়। পরী বিবির সমাধির যে গম্বুজটি আছে তা একসময় স্বর্ণখোচিত ছিল, কিন্তু এখন আর তেমনটি নেই, তামার পাত দিয়ে পুরো গম্বুজটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লালবাগ কেল্লা এর কাঠামো কেল্লাতে একটি মসজিদ আছে, আজম শাহ দিল্লি চলে যাওয়ার আগেই তিনি এই মসজিদটি তৈরি করে গিয়েছিলেন। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি যে কারো দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম। মসজিদটিতে জামায়াতে নামায আদায় করা হয়। ঢাকায় এতো পুরনো মসজিদ খুব কমই আছে। লালবাগ কেল্লাতে এখানে ওখানে বেশ কয়েকটি ফোয়ারার দেখা মিলবে, যা শুধুমাত্র কোনো বিশেষ দিনে চালু থাকে (যেমনঃ ঈদ)। কেল্লাতে সুরঙ্গ পথ ও আছে, লোক মুখে শোনা যায় যে আগে নাকি সুরঙ্গ পথগুলোতে যাওয়া যেতো, তবে এখন আর যাওয়া যায়না। উল্লেখ্য সুরঙ্গ পথ এ যাওয়ার কথাটি নিতান্তই শোনা কথা, এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। লালবাগ কেল্লায় সর্বসাধারণের দেখার জন্যে একটি জাদুঘর রয়েছে, যা পূর্বে নবাব শায়েস্তা খাঁ এর বাসভবন ছিল আর এখান থেকেই তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। জাদুঘরটিতে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। মুঘল আমলের বিভিন্ন হাতে আঁকা ছবির দেখা মিলবে সেখানে, যেগুলো দেখলে যে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারবে না। শায়েস্তা খাঁ এর ব্যবহার্য নানান জিনিসপত্র সেখানে সযত্নে রয়েছে। তাছাড়া তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক, সেসময়কার প্রচলিত মুদ্রা ইত্যাদিও রয়েছে। লালবাগ কেল্লায় পরীবিবির সমাধি রয়েছে। যা মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্যা পরীবিবির সমাধি নামে পরিচিত। বাংলাদেশে এই একটি মাত্র ইমারতে মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রং এর ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছে। কক্ষগুলির ছাদ কষ্টি পাথরে তৈরি। মূল সমাধি সৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের কৃত্রিম গম্বুজটি তামার পাত দিয়ে আচ্ছাদিত। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির এই সমাধিটি ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের পুর্বে নির্মিত। তবে এখানে পরীবিবির মরদেহ বর্তমানে নেই বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। অনুসন্ধানি কিছু বিদেশি পর্যটককে দেখলাম দেয়ালগুলোর ছবি তুলছে আর গভীর মনযোগ দিয়ে দেখছে।হয়ত কোন গবেষক দল তারা। অনেকটা সময় কেটে গেলো সেখানে।এবার ফেরার পালা। কিন্তু লালবাগের এতো কাছে এসে মুফতি আমিনী রহঃ এর কবর জেয়ারত করে না গেলে ভ্রমণটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।লালবাগ মাদ্রাসার সামনে শাহী মসজিদ চত্বরে হযরতের মাকবারা।এখানে অনেকগুলো কবর। হযরতের কবর খোঁজে পাচ্ছিলাম না। সব কবরে নাম ফলক আছে কিছু কবরে তার ব্যতিক্রম।একজন বললো নাম ফলকহীন সবার কাছের কবরটাই মুফতি আমিনী রহঃ এর। কিছুক্ষন দাঁড়ালাম কবরটার কাছে।একটা সিংহ ঘুমিয়ে আছে কতোটা নিরবে।মন টা বিষন্ন হলো। এবার ফেরার পালা। লালবাগ থেকে বাবুবাজার। গুগল বলছে ১৭ মিনিটের পথ।রিকশাওয়ালা ভাড়া হাকালো একশো টাকা। কিছুক্ষণ হেটে চলে আসলাম বাবুবাজারে।তারপর সেই ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহে চড়ে যাত্রাবাড়ি। ততক্ষণে আসরের আযান হচ্ছে চারপাশে। খাইরুল ইসলাম হিমেল বাদ মাগরিব যাত্রাবাড়ি বড় মাদ্রাসা ২৩-১২-২১ ইংপোস্ট লিংকঃ